আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘কমিশন থেকে আমরা বলব, ভোট নিয়ম অনুযায়ী হবে। দিনের ভোট দিনেই হবে। ভোট রাতে হবে না-এটা আমরা স্পষ্ট করে বলছি।’ মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে শনিবার একজন নির্বাচন কমিশনার যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘সিইসি এ ধরনের উদ্ভট কথা বলতেই পারেন না। তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান কিছুটা স্মৃতিভ্রমের কারণে এই বক্তব্য দিয়েছেন।’ ইভিএম নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও জানান সিইসি।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার মাদারীপুরে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিটি দলে আইটি বিশেষজ্ঞ আছেন। তাদেরও আমরা আমাদের মেশিন দেখাব। ইভিএম তাদের হাতে ছেড়ে দেব, দেখান কোথায় ভুল আছে? আর কোন মেশিন কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না। ইভিএমের কোনো ভুলত্রুটি যদি কেউ ধরতে পারেন, তার জন্য আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।’ এই বক্তব্যের বিষয়ে মঙ্গলবার নিজের ও কমিশনের অবস্থান তুলে ধরেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ সময় সেখানে কমিশনার মো. আনিছুর রহমানসহ অন্য কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন। তবে আনিছুর রহমান এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
সিইসি বলেন, ‘এ বক্তব্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। বক্তব্যটি আমার কাছে উদ্ভট মনে হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমন উদ্ভট কথা বলতেই পারেন না।’ তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অবনমিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের যে মর্যাদা, তা ক্ষুণ্ন হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষ যে আস্থা আনতে চায়, শুরুতেই তা যদি বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে জনপ্রত্যাশিত আগামী নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’
সংবাদ সম্মেলন ডাকার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সিইসি জানান, তার বাসায় এখন টিভি নেই, টিভি দেখার সময়ও পান না। ইউটিউবে তিনি দেখতে পেয়েছেন, সেখানে বলা হচ্ছে সিইসি ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। কিন্তু গত ছয় মাসে তিনি ‘টেন মিলিয়ন ডলার’ এই তিনটি শব্দ উচ্চারণই করেননি। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘তার একজন সহকর্মী এটি বলেছেন। তবে ওই কমিশনার সেভাবে বলেননি। এই বক্তব্য শোনার পর ইসি বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করেছে। যারা ইভিএম নিয়ে কাজ করছে, ইভিএম তৈরি করছে, তারা এটা বলেছেন ভালোবাসা বা উচ্ছ্বাস থেকে। সেখান থেকে এই বিষয়টি এসেছে। এটা নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানের বক্তব্য নয়, তিনি আরেকজনের কাছ থেকে শুনে কোট করতে গিয়ে হয়তো একটু বিভ্রান্তি হয়ে গেছে।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কমিশনের বক্তব্য নয়। কোনোভাবে কমিশনের কোনো কর্মচারীও এ কথা বলেননি, কমিশনার তো দূরের কথা, বলতে পারেন না।’ সিইসি বলেন, ‘মিডিয়ার সামনে কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অনেক সময় স্লিপ হয়ে যায়। কোনো কমিশনার ইচ্ছাকৃতভাবে কমিশনকে অপদস্ত করার জন্য, সিইসিকে অপদস্ত করার জান্য বলেননি। কথাটা আসলে কিছুটা স্মৃতিভ্রমের কারণে হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে আমরা কোনো রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। কোনো রকম চাপের মুখে মাথা নিচু করব না, করছি না। আমরা যদি ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে দিই, তাহলে কাল (আজ বুধবার) আবার মিটিং করব কেন। ইভিএম নিয়ে ইতোমধ্যে ৪-৫টি মিটিং করেছি। পুরোপুরি আস্থাভাজন হতে পারিনি। আরও মিটিং হবে। এরপর ওপেন মিটিংও হবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন প্রহসনে রূপান্তর করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। এটা আমরা অন্তর দিয়ে বলছি। সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুস্থধারা প্রবাহিত হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র আরও সুদৃঢ় হোক, সংহত হোক-এটা দেশের একজন নাগরিক হিসাবেও একান্তভাবে কামনা করি।’
নির্বাচন কমিশনাররা পারস্পরিক সহমর্মিতার সঙ্গে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিশ্রম করে কাজ করছেন জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তিনশ আসনে ভোট ইভিএমে হবে বলেছেন। উনি দৈনিক একশবার এ কথা বলতে পারেন। আবার কেউ বলছেন, একটি আসনেও ইভিএমে হবে না। ইভিএম-এর পক্ষে-বিপক্ষে যে কেউ কথা বলতে পারেন। যারা বিপক্ষে বলছেন, তাদের বক্তব্য শ্রবণ করা আমাদের দায়িত্ব। এরপর সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। সাংবিধানিকভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কমিশনের। আমরা মনে করি, আমাদের মধ্যে সেই সাহস, সততা ও নিষ্ঠা আছে।’ তিনি বলেন, ‘কমিশন নিয়ে জনমানুষের অনেক প্রত্যাশা আছে। একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন মানুষ চায়। আমরা যে সংলাপ করেছিলাম, সেখানেও এসব দাবি ও প্রস্তাব এসেছিল। সংলাপে প্রস্তাবের বিষয়ে প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।’
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের বক্তব্য দিনের ভোট দিনে হবে, রাতে হবে না। এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি বলেন, ‘রাতের ভোট নিয়ে হয়তো জনগণের একটা পারসেপশন তৈরি করা হয়েছে। আমি নিজেও জানি না ভোট রাতে হয়েছে কি না? রাতের ভোট হতে আমি দেখিনি। দিনে ভোট হতে দেখেছি। ভোটের সময়ে আমি সিডনি ছিলাম। সেখানে বসে দেখেছি, ফখরুল ইসলাম (বিএনপি মহাসচিব) সাহেব ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয়ে উনি খুব প্রশংসা করেছেন।’
আগের নির্বাচনে রাতে হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমি জানি না। এটা নিয়ে যে অভিযোগ, তা প্রত্যাখ্যান করি না আবার বিশ্বাসও করি না। যে অভিযোগগুলো ব্যাপকভাবে হয়েছে তাতে নেগেটিভ পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে নেগেটিভ পারসেপশন এসে গেছে। আমরা আরও সতর্কভাবে কাজ করতে চাই যে, এই ধরনের পারসেপশন ভবিষ্যতে আর না হয়।’